শুরুর দিকটা এতটা সহজ ছিল না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ের এ মানসিকতা গ্রামের সিংহভাগ মানুষই পছন্দ করতেন না। বরং তার আচরণ অনেকের কাছে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বলেই মনে হতো। পারিবারিক-সামাজিক কোনো সংকটে যখন অন্যরা মুখ ফিরিয়ে নিত তখন সেই ব্যক্তি কিংবা পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে যেতেন তিনি। এভাবেই ধীরে ধীরে তিনি গ্রামের মানুষের কাছে ভরসার ‘রেহেনা আপা’ হয়ে ওঠেন।
কে এই ‘রেহেনা আপা’? তিনি হলেন খরনা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রেহেনা খাতুন। সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের নির্বাচিত সদস্য রেহেনা খাতুন নিজেও বাল্যবিয়ের শিকার। যে কারণে ষষ্ঠ শ্রেণির পর আর পড়ালেখার সুযোগ হয়নি তার। এমনকি বিয়ের দশ বছরের মাথায় স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল তাকে। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে
অন্যের বাড়িতে কাজও করতে হয়েছে। একপর্যায়ে তাকে তালাক দেওয়া হয়। পরে শালিসের মাধ্যমে স্বামীর সংসারে ফেরার সুযোগ সৃষ্টি হলেও ফতোয়াবাজরা হিল্লা বিয়েতে বাধ্য করতে চেয়েছিল।
তিনি দমে যাননি বরং সাহসের সঙ্গে লড়াই করেই আবার শাজাহানপুর উপজেলার খরনা ইউনিয়নের কমলাচাপড় গ্রামের পান ব্যবসায়ী মোকারেম হোসেনের সংসারে ফিরেছেন।
‘আমাদের এই গ্রামগুলোতে আগে বাল্যবিয়ের প্রবণতা এতটাই বেশি ছিল যে, অষ্টম কিংবা নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর মেয়েদের আর স্কুলে ধরে রাখা যেত না। বিয়ের কারণে ওই দুটি ক্লাসে ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে যেত। এখন বাল্যবিয়ের কথা তেমন শোনা যায় না। সে কারণে বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের উপস্থিতিও বেড়েছে। এর পেছনে রেহেনা আপার অনেক অবদান।’ বলছিলেন, বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার খরনা নাদুরপুকুর ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জাহিদুর রহমান।
বগুড়া শহর থেকে দক্ষিণে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে কমলাচাপড় গ্রামের গৃহবধূ মনোয়ারা বেগম জানান, রেহেনার আগে কোনো মেয়ে এ গ্রামে সাহস করে এত কথা বলতে পারত না। তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী রেহেনাই আমাদের মতো মেয়েদের সাহসী করে তুলেছেন।’ নাদুরপুকুর গ্রামের সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথম দিকে রেহেনা খাতুন সল্ফপর্কে আমাদের ভুল ধারণা ছিল। কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের সবার ভুল ভাঙে। আমরা বুঝতে পারি তিনি যা করছেন তা আমাদের সবার ভালোর জন্যই।’
নিজের লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে রেহেনা খাতুন জানান, দেড়-দুই বছর বয়সে তার মা মারা যান। বাবা আবার বিয়ে করেন। সৎ মায়ের নির্যাতনের কারণে ঠাঁই হয় নানির ঘরে। ১৯৯৫ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের ২-৩ বছরেও স্বামী-সংসার কী, তা তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। বয়স বাড়ার সঙ্গে যখন কিছুটা বুঝে ওঠার চেষ্টা করছিলেন তখনই স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেয়। চলে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন। এভাবে কয়েক বছর চলার পর ২০০৪ সালের দিকে স্বামী তাকে গোপনে দুই তালাক দেন। ততদিনে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে রেহেনা পাশের গ্রামে তার মামার বাড়িতে আশ্রয় নেন। আদালতে স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের মামলা করেন। প্রথম দিকে মামা মামলার খরচ চালালেও আর্থিক অনটনের কারণে এক সময় অপারগতা প্রকাশ করেন। তখন বাধ্য হয়েই রেহেনাকে কাজের সন্ধানে নামতে হয়।
রেহেনা খাতুন বলেন, ‘মামলার প্রতিটি তারিখে আদালতে যাওয়া-আসা এবং আইনজীবীর ফিসহ অন্তত ১ হাজার টাকা খরচ হতো। এভাবে প্রায় দুই বছর কেটে যাওয়ার পর ২০০৭ সালে বগুড়া শহরে একটি বিয়ের বাড়ি সাজাতে গিয়েই পরিচয় হয় বেসরকারি সংস্থা প্রোগ্রাম ফর ইকো সোস্যাল ডেভেলপমেন্টের (পেসড) নির্বাহী পরিচালক মাহফুজ আরা মিভার সঙ্গে। পরে তিনি সালিশের মাধ্যমে স্বামীর সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির আশ্বাস দেন। শুনানিতে উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে মাহফুজ আরা মিভা বুঝতে পারেন যে, অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে রেহেনা খাতুনকে স্বামী নির্যাতন করতেন।
কয়েকবার কাউন্সিলিংয়ের পর মোকারেম রেহেনাকে আবার সংসারে ফিরিয়ে নেন। নিজের জীবনের এই কালো অধ্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকেই বাল্যবিয়ে আর হিল্যা বিয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করি।’
এ পর্যন্ত কতজনের বাল্য আর হিল্যা বিয়ে বন্ধ করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে রেহেনা খাতুন বলেন, ‘এগুলো যে গুনে রাখতে হবে, সেটা তো কখনও মনে হয়নি। প্রায় ৯ বছর আগে যখন প্রথম কাজ শুরু করেছিলাম, তখন তো ৫-৬ মাস পরপরই বাল্যবিয়ের আয়োজনের কথা শুনতাম। তখন বিয়ে বন্ধ করতে গেলে অপদস্ত হতে হতো। যারা গোপনে গোপনে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সামাজিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন তারাও পরামর্শের জন্য আমার কাছেই আসতেন। এভাবে আমার কর্মকান্ড সল্ফপর্কে মানুষের ভুল ভাঙতে শুরু করে।’
নাদুরপুকুর ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা আকতার বানু বলেন, ‘রেহেনা আপা স্কুলে এসে বাল্যবিয়ে নিয়ে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার কথায় ছাত্রছাত্রীরা সচেতন হয়েছে।’ ওই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী মনিশা আকতার জানায়, রেহেনা খাতুন তাদের কাছে বাল্যবিয়ের কুফলগুলো তুলে ধরেছেন এবং কোনো ছাত্রীকে গোপনে বিয়ে দেওয়ার আয়োজনের কথা শোনা গেলে তাকে জানাতে বলেছেন।
পেসড-এর নির্বাহী পরিচালক মাহফুজ আরা মিভা বলেন, ‘রেহেনা খাতুনকে সেই ছোটবেলা থেকেই অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। এরপরও সে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে। আজ সে নিজের পরিবার থেকে গ্রাম এমনকি ১৫টি গ্রাম নিয়ে গঠিত সংরক্ষিত একটি ওয়ার্ডের মানুষের আস্থার প্রতীক।’
খরনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান শাহীন জানান, তার পরিষদে যে ৩ জন নারী সদস্য রয়েছেন, তাদের মধ্যে রেহেনা খাতুন ব্যতিক্রমী। তিনি বলেন, ‘রেহেনা প্রতিবাদী এবং সাহসী। সমকাল
পাঠকের মতামত